সোনালী যুগ থেকে নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনার দিকে


এক সময় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রাজত্ব করত ফুটবল। ঢাকার লীগ মানেই ছিল গ্যালারি ভর্তি দর্শক, আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে উত্তেজনার পারদ ছুঁয়ে যেত আকাশ। তৎকালীন সময়ে পাড়ায় পাড়ায় খেলা হতো ফুটবল, রেডিও বা টেলিভিশনে ম্যাচ শোনার/দেখার জন্য চলত প্রতিযোগিতা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্রীড়াক্ষেত্রে ক্রীকেটের আগমন ও আধিপত্য ফুটবলের সেই গৌরব ধুয়ে নিয়ে যায়।


তবে আশার আলো এখনও নিভে যায়নি। বর্তমান প্রজন্মের কিছু ক্লাব, প্রাইভেট একাডেমি ও তরুণ ফুটবলারের মাধ্যমে আবারও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশি ফুটবল। এই নিবন্ধে আমরা ফিরে দেখব সোনালী অতীত, বিশ্লেষণ করব বর্তমান পরিস্থিতি এবং নজর দেব আগামী দিনের সম্ভাবনার দিকে।


সোনালী যুগ: ৭০ ও ৮০-এর দশকের গৌরব


বাংলাদেশে ফুটবলের প্রকৃত সোনালী যুগ বলা হয় ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশককে। এই সময়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফুটবল, আর এর মূল আকর্ষণ ছিল দুই পরাশক্তি ক্লাব—আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।


এই দুই ক্লাবের মুখোমুখি লড়াই মানেই ছিল ঢাকার গ্যালারি উপচে পড়া ভিড়, টিকিটের জন্য রাত জাগা এবং শহরজুড়ে এক অনন্য উন্মাদনা। আবাহনী-মোহামেডান ডার্বি এমন এক সাংস্কৃতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল, যা শুধুমাত্র খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—এটি মানুষের পরিচয়, আবেগ ও গর্বের অংশ হয়ে উঠেছিল।


ঢাকা লীগ ছিল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট। এই লীগে খেলেছেন দেশীয় কিংবদন্তি যেমন বাদল রায়, আসলাম, চুন্নু, সালাহউদ্দিন, এবং বিদেশি তারকারাও। সে সময় খেলোয়াড়দের পোস্টার, গানের ক্যাসেট, এমনকি নাটকেও ফুটবলের ছায়া দেখা যেত।


রেডিওতে ম্যাচের ধারাভাষ্য শুনতে বসে যেত পুরো পরিবার, আর পাড়ার মোড়ে মোড়ে চলত উত্তেজনাপূর্ণ বিশ্লেষণ। বলা যায়, ফুটবল ছিল জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।


আজকের দিনে যেমন অনলাইনে বাজি খেলার সাইট নিয়ে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে ক্রিকেট বা ইউরোপিয়ান ফুটবল ঘিরে, তেমনই সেসময় আবাহনী বনাম মোহামেডান ম্যাচ ঘিরে থাকত ভবিষ্যদ্বাণী, আলোচনা ও সাপোর্টারের ‘মৌখিক বাজি’।


এই সোনালী সময়টাই প্রমাণ করে—বাংলাদেশে ফুটবলের জন্য আবেগ নতুন কিছু নয়, বরং সেটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা।



পতনের সূচনা: কিভাবে ক্রিকেট ফুটবলকে ছাপিয়ে গেল


৯০-এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশে ক্রিকেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এই খেলা একটি জাতীয় উন্মাদনায় পরিণত হয়। অন্যদিকে, ফুটবল হারিয়ে যেতে থাকে মিডিয়া কাভারেজ, সংগঠন ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।


🇧🇩 ক্রিকেট বনাম ফুটবল: জনপ্রিয়তা ও কাঠামোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ (১৯৯৫–২০২৫)










ক্ষেত্র

ফুটবল (⬇ পতন)

ক্রিকেট (⬆ উত্থান)

ফেডারেশন/বোর্ড পরিচালনা

দুর্বল, নেতৃত্বহীন

BCB সুসংগঠিত ও রাষ্ট্রসমর্থিত

মিডিয়া সম্প্রচার

সীমিত, অনিয়মিত

সর্বব্যাপী টিভি/অনলাইন কাভারেজ

জাতীয় দলের পারফরম্যান্স

সাফল্যের অভাব, ফিফা র‍্যাংকিং⬇

ওডিআই/টি২০ জয়ে ধারাবাহিকতা⬆

স্পনসর ও পৃষ্ঠপোষকতা

প্রায় নেই

বহুজাতিক ব্র্যান্ড, নিয়মিত চুক্তি

জনসম্পৃক্ততা

শহরকেন্দ্রিক, কমছে

গ্রামীণ এলাকায়ও জনপ্রিয়তা



মূল কারণগুলো:


  • বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (BCB)-এর পরিকল্পিত কার্যক্রম ও মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় ক্রিকেট দ্রুত সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।

  • অন্যদিকে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন দুর্নীতি, নেতৃত্বের অভাব ও স্পনসর ঘাটতির কারণে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে পড়ে।

  • টেলিভিশনে ফুটবল সম্প্রচার নিয়মিত না হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই ইউরোপিয়ান ক্লাব অথবা ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে।


ফুটবলের এই পতনের পেছনে শুধু খেলার মান নয়, সংগঠনগত ব্যর্থতাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।


বর্তমান অবস্থা: এখন কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশি ফুটবল?


আজকের দিনে বাংলাদেশের ফুটবল একটি সংকটময় কিন্তু সম্ভাবনাময় পর্যায়ে অবস্থান করছে। সোনালী অতীতের সেই গৌরব আর নেই, তবে কিছু ক্লাব ও ব্যক্তি উদ্যোগ ফুটবলের প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এই বাস্তবতা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখতে হবে চারটি মূল দিক:


১. বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (BPL)-এর মান


BPL দেশের শীর্ষস্থানীয় ঘরোয়া ফুটবল লীগ হলেও এর মান ও প্রতিযোগিতামূলকতা অনেকটাই সীমিত। কিছু ক্লাব যেমন বসুন্ধরা কিংস আধুনিক অবকাঠামো, বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অনেক ক্লাব এখনো পেশাদার কাঠামোর বাইরে রয়ে গেছে।


  • দর্শকসংখ্যা কম

  • ম্যাচ কাভারেজ সীমিত

  • লীগ শিডিউল প্রায়শই অনিয়মিত


২. একাডেমি ও প্রশিক্ষণের অবস্থা


দেশব্যাপী সরকারি বা ফেডারেশন পরিচালিত একাডেমির সংখ্যা কম। বেশিরভাগ প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রাইভেট উদ্যোক্তার উপর নির্ভরশীল। কোচদের মান, ট্রেনিং মডিউল ও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড প্রায়শই অনুপস্থিত।


তবে কিছু নতুন একাডেমি, যেমন FC Uttara বা Fortis Academy, ধীরে ধীরে উন্নত পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।


৩. জাতীয় দলের পারফরম্যান্স


বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ফিফা র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়েছে এবং SAFF কিংবা এশিয়ান কাপেও বড় কোনো অর্জন করতে পারেনি। ম্যাচের মান, স্কিল লেভেল এবং ফিটনেসে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দলের তুলনায় পিছিয়ে আছে।


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে এলেও তাদের যথাযথ ব্যবহার ও ধারাবাহিক উন্নয়নের ঘাটতি রয়েছে।


৪. মিডিয়া কাভারেজ ও স্পনসরশিপ


ফুটবল ম্যাচের সম্প্রচার এখনো নিয়মিত নয়, টিভি ও অনলাইন মিডিয়ায় ক্রিকেটের প্রাধান্য স্পষ্ট। ফলে স্পনসররা ফুটবলের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।


  • বড় ব্র্যান্ডের আগ্রহ নেই

  • ম্যাচের হাইলাইটস বা বিশ্লেষণ খুব কম

  • সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু ক্লাব নিজেদের প্রচার চালাচ্ছে, তবে তা সীমিত


আশার আলো: নতুন প্রজন্ম ও প্রাইভেট উদ্যোগ


যদিও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের ফুটবল ছিল অবহেলিত, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু প্রাইভেট ক্লাব, একাডেমি ও উদ্যোক্তা দৃশ্যপট পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছে। মাঠে ও মাঠের বাইরে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ফুটবলপ্রেমীদের আশাবাদী করে তুলেছে।


বসুন্ধরা কিংসের নেতৃত্বে পেশাদার বিপ্লব


বসুন্ধরা কিংস দেশের অন্যতম আধুনিক ও সংগঠিত ক্লাব হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা:


  • আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম ও অনুশীলন সুবিধা গড়ে তুলেছে

  • দক্ষ বিদেশি কোচ ও খেলোয়াড় নিয়োগ করেছে

  • ঘরোয়া লীগে ধারাবাহিকভাবে আধিপত্য বজায় রাখছে

  • মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে প্রচার চালাচ্ছে


এই ক্লাব মডেল অন্য ক্লাবগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।


নতুন একাডেমি ও প্রশিক্ষণ উদ্যোগ


সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রাইভেট একাডেমি যেমন Fortis FC, Saif Sporting Membership বা Baridhara Youth Academy তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ শুরু করেছে আধুনিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে।


  • উন্নত ফিটনেস প্রোগ্রাম

  • ভিডিও অ্যানালাইসিস

  • বিদেশি কোচদের ওয়ার্কশপ

  • স্কুল-কলেজ লেভেল থেকে খেলোয়াড় সংগ্রহ


মিডিয়া, ডিজিটাল ফ্যানবেস ও সোশ্যাল রিচ


অনেক তরুণ ফুটবলভক্ত এখন ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটক-এ দেশীয় ফুটবল নিয়ে কনটেন্ট তৈরি করছে। ম্যাচ হাইলাইটস, বিশ্লেষণ, টপ-৫ গোল — এসব কন্টেন্ট তরুণ প্রজন্মকে ফুটবলের দিকে ফিরিয়ে আনছে।


এছাড়াও কিছু ক্রীড়া-ব্লগ ও পোর্টাল ফুটবলভিত্তিক কুইজ, ট্রিভিয়া ও অনলাইনে বাজি খেলার সাইট নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলছে।


উপসংহার – ফুটবলের বসন্ত কি আবার ফিরে আসবে?


বাংলাদেশে ফুটবলের ইতিহাস গৌরবময়, তবে বাস্তবতা বলছে—এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। সোনালী অতীতের উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেলেও, বর্তমান সময়ে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন সেই আলোকে আবার উজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।


প্রাইভেট ক্লাবের পেশাদারিত্ব, নতুন একাডেমির আধুনিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, তরুণদের ডিজিটাল আগ্রহ এবং সর্বোপরি ফুটবলপ্রেমীদের আবেগ — এই সব মিলিয়ে গড়ে উঠতে পারে এক নতুন পথ, যেখানে বাংলাদেশ আবারও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শক্ত অবস্থান নিতে পারে।


তবে এর জন্য দরকার হবে—


  • সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

  • ফেডারেশনের স্বচ্ছতা ও কার্যকর নেতৃত্ব

  • মিডিয়া ও কর্পোরেট হাউজের সমর্থন

  • ঘরোয়া পর্যায়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন


আমরা বিশ্বাস করি—ফুটবল আমাদের রক্তে আছে, শুধু দরকার সেই সঠিক কাঠামো ও দিকনির্দেশনা।


আপনি কি মনে করেন, ফুটবল আবার দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হতে পারবে? নিচে কমেন্ট করুন এবং আপনার মত শেয়ার করুন!


প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)


প্রশ্ন ১: বাংলাদেশে ফুটবলের সোনালী যুগ কখন ছিল?


উত্তর: ১৯৭০ ও ৮০-এর দশককে বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালী যুগ বলা হয়। তখন আবাহনী-মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঢাকা লীগ-এর জনপ্রিয়তা এবং গ্যালারি ভরা দর্শক দেখা যেত।


প্রশ্ন ২: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (BPL) কি পেশাদার লীগ?


উত্তর: হ্যাঁ, এটি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পেশাদার ফুটবল লীগ। তবে অধিকাংশ ক্লাব এখনো আধুনিক পেশাদার কাঠামোর ঘাটতিতে ভুগছে।


প্রশ্ন ৩: কেন বাংলাদেশে ফুটবল জনপ্রিয়তা হারিয়েছে?


উত্তর: মূলত ক্রিকেটের উত্থান, মিডিয়া কাভারেজের অভাব, দুর্বল ফেডারেশন ও স্পনসর ঘাটতির কারণে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে।


প্রশ্ন ৪: ফুটবল পুনরুজ্জীবনের জন্য কী করা দরকার?


উত্তর: প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, একাডেমিক ও কোচিং উন্নয়ন, মিডিয়ার সমর্থন এবং তরুণদের যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।


প্রশ্ন ৫: বাংলাদেশ কি আবার দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শক্ত অবস্থানে ফিরতে পারবে?


উত্তর: যদি সঠিক পরিকল্পনা, নেতৃত্ব এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ আবার ফুটবলে শক্ত অবস্থানে ফিরতে পারে।





Supply hyperlink

Related articles

Comments

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share article

Latest articles

Newsletter

Subscribe to stay updated.